তুই আবার এত কষ্ট করে এই শত শত মাইল পাড়ি দিয়ে এগুলো আনলি ?
- কি অরব, কও ? শীত আলি পরে যহন গাছে ছ্যান ( খেজুর কাটা কাঁচি) বসাই তহন তো তুমাগে চেহারা গলুন ছবির মত ভাইসে ওঠে। যতই মানা অর, মন রে তো বুজোতি পারি নে রে ভাই । এই নেও । এত ফত আনতি আনতিতো বাসী অইয়ে যায় । টাটকাতা খাতি তো তুমাগে আর মন চায় না । মনডারেতো পাষান বানাইয়ে ফ্যালাইছো । আর তুমাগে আওলাদ-বইন্যাদগেওতো (ছেলেপেলে) এই সগ্গল নিয়ামত থেইহেও বঞ্চিত অইরলে । তা, আমার আর না আইসে উপায় কি কও ? তুমাগে থুইয়ে এইয়ে যহন খাতি যাই, তহন তো তা আর গলা দিয়ে নামতি চায় না ।
ওর আবেগ ঘন কথা শুনে আমার মনটাও ভারী হয়ে উঠল । আবেগ সামলিয়ে বললাম,
তুই কিন্তু আবার আমাকে তুমি –তুমি করছিস, জানিস না, তুই যখন আমার সেই ছেলেবেলার সাথি থেকে আমাকে আলাদা করে ভাবিস তখন আমার খুব রাগ হয় ?
- তাতে আর কি অইছেরে , বাই --। তোরা কত লেহা ফড়া অইরে বড় সাহেব অইয়ে গেছ ।
এই তো , দেখচিস, তুইতে গেলি , অথচ কথা শেষ হতে না হতে আবার ?? মারব কিন্তু একটা ---
- শোন, গিরাম এহন কলি আর গিরাম নাই , টাওন (শহর) অইয়ে যাচ্ছে । মদুমোতির সেই গাং তো মইরে আঠু (হাটু) পানি অইয়ে গেছে । তবু অইয়ের উপর দিয়ে বিরিজ (ব্রীজ) বানাইছে । গাদলার দিন (বর্ষা কাল) আলি পরে কিছুদিন গাংগের মত মনে অয় । এহন তুমরা গাড়ি নইয়ে এহেবারে খল্টে (উঠানে) চইলে আসথি পারবানে । কই কি, শীত আলী ছাওয়াল মাইয়েগে ইসকুল বন্ধ পালি বাড়ি আসফা । তালি তো আমার আর কষ্ট অরতি অয় না । তুমরাও শান্তি পাবা । তয় গাদলার দিন কলি আসফানা । বেশী গাদলা অলি আবার খল্টে (উঠানে) পানি উইঠে যায় । তহন আবার তুমাগে কষ্ট অবে ।
হুম । তুই ঠিক কইছিস । ভাবতিছি, এখন থেকে প্রতি বছর ছেলে পেলে নিয়ে বাড়ি যাব । না হলে ওরা নাড়ির টান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে ।
- নাড়িতো ছিইড়েই ফেলাইছ । অরা কি আমাগে চেনে ? তুমিই তো -- , দেহনা, আগের মত আর আমাগে মত কথা কথি পার না । এট্টু শুরু অরিছিলে, আবার পাইরলেনা , তালি তোমার আওলাদ-বইন্যাদগে অবস্থা কি অতি পারে, কও ?
না, রে তোকে গতবছর যখন ওরা দেখে অবাক হয়েছিল ,তখন তোদের সবার ছবি ওদের মনের মধ্যে এঁকে দিয়েছি । আমার সাথে তো রোজ তোদের গল্প শুনতে চায় । ওরা বায়না করেছে, স্কুল বন্ধ হলেই বাড়িতে যাবে । এবার দেখিস , এরা তোকে দেখলেই কি করে ।
- তাই নেকি ? শুইনে মনডা জুড়োয় গেল রে , বাই । শোন, এহন কিন্তু খেজুরির বাগানডা বেশ ডাংগর অইয়ে উঠথিছে । নতুন নতুন চারা অতিছে । এইবার ১৪ ডা গাছ ঝুড়িছি । মেলা রস অইছে । তুমাগে জন্যি এই দুই ঠিলে(কলস) ঝুলা (নরম) আর পাটালি দুই আড়ি (হাড়ি) বানাইয়ে আনছি । বছরডা ভইরে খাতি পারবানে । আর আগের মত সেই উড়ুমির (মুড়ির) ধানের বেছন (বীজ) এহন তো পাওয়া যায় না । তয় কী আর অরব, আমনের চাইল দিয়েই উড়ুম ভাইজে দেছে তোর ভাবি । তুমাগে এইহেনে কি বড় কোলা (মাটির তৈরী বড় হাড়ি) কিনতি পাওয়া যায় ? তালি পরের বার এক কোলা ভইরে মুড়ি যাতে রাখতি পার, তা ভাইজে আনবানি ।
বরাবরের মত এবারও ব্যতিক্রম হল না । রুহুল একবার তুই, একবার তুমি মিশিয়ে কথা বলছে । আর রাহাত প্রাণ ভরে সে কথাগুলো উপভোগ করছে ।
ওরে পাগোল, তুই এখন থাম । তোর কথা শুইনে আমার মাথা ঘুরতিছে রে । তুই শুরু করলি কি ক দেহি ? এই দেখছিস, পারিনে বলে ? ওরে বাইরে , মাটির গন্ধ সব ভুইলে যাইনি রে -- । যাক, শোন, অনেক হইছে । এহন তুই নাইয়ে আয় । নালি তোর ভাবি ইসকুলিতথে বাচ্চারে নিয়ে আইসে তোরে যদি এরম গল্প করতি দেহে, তালি কিন্তু আমার উপর খেইপে যাবে নে । যা ওঠ ওঠ ।
-হ, যাতিছি ।
--------
ছোট কন্যাকে নিয়ে রাহাতের মিসেস এই মাত্র ঘরে ঢুকলেন । রুহুলের পাগলামী দেখে তো অবাক !
হায় আল্লাহ ! এসব কি ? পাগোলটা আবার ? আচ্ছা, কেন ও এত কষ্ট করে বলত ? কৈ গেছে সে ?
-গোসলে ঢুকালাম এই মাত্র ।
আব্বু, চাচ্চু এসেছে ? পিঠা, গুড় , মুড়ি নিয়ে ? কী মজা !! কী মজা !! মিয়া ভাই আর ছোট ভাই যে কী খুশী হবে , তা বলে শেষ করা যাবে না ।
-হ্যা, মা । সবাই খুশী হবে । আর তোমাদের সবার খুশীতেই ওর যত আনন্দ ।
মাথা মুছতে মুছতে রুহুল বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল । তখনও তার চোখ মুখ গামছার আড়ালে ।
-ধু—উ—রু এ্যাট্টুক একখান খেচার (খাচা) মধ্যি নাইয়ে শান্তি পাওয়া যায় ? এহানে কোনহানে ফুহইর (পুকুর) , গাং টাং (নদী –টদি) নাই ?
রাহাতের দিকে আসতেই রুহুল চমকে গেল একটি আওয়াজ শুনে ।
চাচ্চু, আস-সালামুআ’লাইকুম । কেমন আছেন ?
-ওয়া আলাইকুম সালাম । মা ভাল আছি । তুমে কেমন আছ ? ও ভাবি, তুমি আইসে গেছ ?
তা, তুই আর কতকাল আমাদের জন্য এই কষ্ট করবি , ভাই ? এবার একটু খান্ত দে । এর পর থেকে আমরাই যাব ঠিক করেছি । তোকে আর এভাবে কষ্ট দেয়া যায় না । আয় ডায়নিং এ আয় । খাবি চল ।
-এই দেহ , ভাবি , তুমি অইছ আমাগে মা চাচীগে মত । আমাগে মা চাচীগে সারা জীবন দেইহা আইছি, অনেক দুরিত্তে ঘরে ফিইরে আসলি আগে প্যাটের দিহি চাইয়ে দেহে, ছাওয়ালডার প্যাট টা কি ফিটির (পিঠের) সাথে মিইশে গেছে , না কি ? তুমারে আল্লা আমাগে মা চাচী অইরে আমাগে রাহাতের সংসারে ফাটাইছে (পাঠিয়েছে) । আল্লা তোমারে রহম করেন ।
থাক, আমার জন্য এরকম লম্বা দোয়া করা লাগবে না । আল্লাহ আমার সব দিক দিয়ে সহায় আছেন । তোর মত ভাই যে সংসারে থাকে, সেখানে কি রহমতের ভান্ডার না থেকে পারে ? আয়, খাবি চল । আর দেরী করিস না তো ? সেই কখন খেয়ে বেরিয়েছিস, পথে তো কিচ্ছু খাইস নাই, ঠিক কি না ?
ধু—র—উ । ফতে ঘাটের খাওয়া দাওয়া আমার কাছে ঘিন্না ঘিন্না লাগে । অইয়ে মানষি খায় ? থু—
নে হয়েছে , এখন আয় তো ।
কিছুক্ষণ পরে দুই ছেলে এল স্কুল থেকে । চাচাকে দেখেই আনন্দে আত্মহারা ।
আস-সালামুআ’লাইকুম, চাচ্চু । আস-সালামুআ’লাইকুম, চাচ্চু । কেমন আছেন ?
-ওয়া আলাইকুম সালাম । আলহামদুলিল্লা, ভাল আছি বাবারা , বইচে থাহ , বইচে থাহ । (দুই ছেলে চাচার দুই পাশে এসে দাঁড়ালে চাচা ওদের টেনে বুকের কাছে নিল)। মেয়েটা দেৌড়ে এসে বলল,
শুধু ভাইয়াদের আদর ? আমার আদর কৈ, চাচ্চু ?
-ওলে আমার মারে ---আস, মা আস । আমার বুহির মধ্যি আস ।
তাকেও বুকে টেনে নিয়ে আবেগে উচ্ছসিত হয়ে বলল,
-আল্লা বাঁচাইয়া রাহুক, মা, মেলা বড় অও , আল্লা তুমাগে অনেক ভাল মানুষ অওয়ার তেৌফিক দেন । আইজকে যে আমার কী খুশী লাগতিছে, তা তোমাগে বুজাতি পারবা না রে । আমার –আমার--।
বলে আবেগে কেঁদেই ফেলল । খানিক চুপ থেকে আবেগ সামলে হেসে আবার বলল,
-আল্লা তোমাগে বাচাইয়ে রাহুক । অনেক বড় অও সোনা মনিরা ।
রাহাতের পরিবার এবার রুহুলকে সহজে আর ছাড়ছে না । আর মাত্র ৫ দিন পরে সবার স্কুল ছুটি । সুতরাং এবার হবে আসল মজা। ছেলে মেয়েরা বায়না করেছে, আগে চাচাকে নিয়ে তারা ঢাকা শহরে ঘুরবে, বেড়াবে, তারপরে চাচার সাথে একসংগে বাড়িতে যাবে বেড়াতে । লম্বা ছুটি কাটিয়ে আসবে সবাই । সে কত রকম বায়না । গ্রামে যেয়ে পিকনিক করবে । সব বন্ধুদের জানিয়ে দেবে তাদের এই আনন্দের কথা । আরো কত যে গ্রাফিক চিত্র আঁকছে কয় ভাই বোন মিলে ! আহা !
-কিন্তু , আমার কি অকম্মা বইসে থাকলি অবে নে ? কও ? ওদিকি গাছ তো শুহোইয়ে (শুকিয়ে) যাবে নে । খ্যাতের (ক্ষেতের) দিক নজর না দিলি কিডা দ্যাখফেনে কও ?
এবার তোর বউরেও মোবাইল কিনে দেব । তুই আসার আগে আমাকে যদি ফোন দিতি, তালি কি এই সমস্যা অত, ক ? যাক, যা হইছে, ভাল হইছে, এবার তোরে ঢাকা শহরটা ঘুরিয়ে দেখাব ।
-ফোন দিলি তো তুই আমারে আটকাইয়া রাখতি । আসতি মানা অরতি , সেই জন্যি তো কিছু না কইয়ে চইলে আসলাম । শোন, তুরা আয় । আমি আগে চইলে যাই , নালি খেতের আর খেজুর গাছের খেতি অবে নে ।
পাশের বাড়ির কারো মোবাইল নম্বর আছে , তোর কাছে ?
-আছে । রাহেলা বুজির ছাওয়াল পুলিশি চাকরী অরে যেডা, অইডে অর মারে মোবাইল কিইনে দেছে । নে, কথা ক ।
তুই নম্বর টা দে, আমি কল দিচ্ছি । এই -- ।
হ্যালো, রাহেলা বুজি ? আমি রাহাত ।
-ওরে বাই রে, এতকাল পরে বুজিরি মনে অল , আমার কি কপাল ! ও ভাডি, ভাল আছিস ? রুফল (রুহুলকে গ্রামের সবাই রুফল বলে ডাকে) তো গেছে তোগে বাড়ি । বারি কষ্ট অরে তোগে নেইগে ।
হ, বুজি । পাগোলটারে কত, কই । শোনে না । আমরা এবার আসতিছি, বাড়ি । বুজি তুমি একটু রুহুলের বউয়ের কাছে মোবাইলটা দাও ।
-হ । এই যে দিতিছি । ও আমার ধারেই বসা আছে । নে কথা ক ।
ভাই, আস-সালামুআলাইকুম । কেমন আছেন ?
-আমাকে আছেন বলছ, ভাবি ? তালি কিন্তু আর –
নেও , অল । তা কি মনে অইরে , বাই ।
শোন ভাবি, রুহুলকে নিয়ে একসাথে আসব । আমাদের আরো ৫ দিন দেরী হবে । এই কয়দিন খেজুর গাছ না কাটলে কোন ক্ষতি হবে না । তবে তুমি কলাই আর আখের ক্ষেতের দিকে একটু কাউরে নজর রাখতে বলবা । পারবা না ?
খুব পারবানি । আস, তোমরা , ধিরি সুস্থি ।
আচ্ছা, ভাবি । এই নেও রুহুলের সাথে কথা বল ।
-ও রাসেলের মা, শোন , কাগাইনের ছাওয়ালরে এই কয় রাত্তির কুশইরির (আখের) খ্যাতের মাচাং এ টস লাইট নিয়ে থাকতি কবা। না লি কলাম কুশোইর সব শিয়েলে খাইয়ে ফেলবেনে , আর চোরারাও সব সাফা অইরে দেবে নে । দিনির বেলা তুমি দেইহে রাইহ । দেহ, পাগোলগে কান্ড, আমারে শহর দেহাবে বইলে বাইন্দা রাহিছে । আচ্চা, ক’ দি দেহি, কামের মানসির আকাইমে থাকতি ভাল ঠেহে ? কি আর অরি । অর ছাওয়াল মাইয়েরা আমারে ছাড়তিছে না । আচ্ছা রাহ ।
--আপনি এসে আমাদের যাওয়াটাই তো ক্যান্সেল করে দিচ্ছিলেন ? জানেন, চাচ্চু, আব্বু বলছিল, এবার আমাদের সবাইকে নিয়ে গ্রামে যাবেন । কিন্তু ---আপনাকে দেখে মনে হল, এই রে, আর যাওয়া হবে না বুঝি । কিন্তু এখন খুব ভাল লাগছে ।
আরে বাছা !
এই হল এবারের শিতের গল্প এবং হারিয়ে যাওয়া গ্রামীন ঐতিহ্যকে ধরে রাখবার ছোট্ট প্রয়াস । আপনারাও এরকম আনন্দ উপভোগ করতে ভুলবেন না যেন ।
-----------------